বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণে তথা সন্তানলাভের আকাঙ্খায় আকুল তামাম দুনিয়ার মানুষের কাছে বিগত দুই দশকে ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় গন্তব্য। ART (assisted reproductive technologies) প্রযুক্তির যুগান্তকারী সাফল্য্, যথা IVF (in vitro fertilization) সফল হবার ফলে, পরিবর্ত্ত গর্ভাবস্থা ( surrogate pregnancies) পরিসেবার সন্ধানে উত্তরের দেশগুলো থেকে মানুষের ঢল নামছে ভারত ও অন্যান্য দক্ষিনদেশগুলোয়। এর মূল কারণ হল সুলভে প্রাপ্ত উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা, পেশাদারী যত্ন এবং সর্বোপরি অল্পমূল্যে লব্ধ ব্যবহারযোগ্য সক্ষম দেহ।
“ surrogate” শব্দটি এসেছে ল্যাটিন “surrogatus” বা “surrogare” থেকে, যার অর্থ ‘বিকল্প’ বা ‘পরিবর্ত্ত’। একজন পরিবর্ত্ত কর্মী বা গর্ভমাতার ( surrogate mother) কাজ হল অন্য এক রমনীর বকলমে সন্তানধারণ করা। ১৯৭০ সাল অব্যবহিত সময়ে ART প্রযুক্তিতে নয়া উদ্ভাবনের ফলে ‘পরিবর্ত্ত মাতৃত্বের প্রয়াসটি নিদানশালা ও দালালকেন্দ্রিক এক শিল্পের চেহারা নিয়েছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবর্ত্ত মাতৃত্ব আদতে গর্ভকালীন দায়ে পর্যবেসিত একটি বন্দোবস্ত, যেখানে গর্ভস্থ সন্তানের সাথে জন্মদাত্রীর কোনো জন্ম-পরম্পরা নেই। কেবল জঠরটি সন্তান উৎপাদন প্র্রকোষ্ঠ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। IVF প্রণালীতে ভ্রুনের সৃষ্টি করা হয় যথাক্রমে সম্পাদনকারী পুরুষ ও নারীর শুক্রানু ও ডিম্বানুর গর্ভাধানের মাধ্যমে। অন্যদিকে, চিরাচরিত পদ্ধতিতে গর্ভমাতা স্বয়ং তার ডিম্বানুটি নিঃস্বার্থে প্রদান করেন সেক্ষেত্রে তিনি একাধারে ভূমিষ্ঠ সন্তানের ধাত্রী ও প্রকৃত, ‘জন্মদাত্রী মা’। যদি এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক উদ্যোগ থাকে, তাহলে তা আবার আরেকধরনের মাত্রা যুক্ত করে। পরিবর্ত্ত মাতৃত্বের ব্যবস্থাপনায় এতোরকম প্রকরণ চালু থাকার কারনে তা অনেকক্ষেত্রেই সন্তানের অভিভাবকত্ব, নাগরিকত্ব, জ্ঞাতি-সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরী করছে; ‘স্বাভাবিক’ ও ‘কৃত্রিম’ এর সীমারেখা অস্পষ্ট করে দিচ্ছে।
পরিবর্ত্ত মাতৃত্বের সাথে সম্পর্কিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিস্থাপন ও তার পণ্যকরণ; মাতৃত্বের অধিকারসংক্রান্ত সমস্যা, একধরনের কানুনী উদ্বেগ তৈরী করছে। অন্যদিকে ২০০২ সাল অব্যবহিত সময়ে ‘transnational commercial surrogacy’ আইনসম্মত হয়ে যাওয়ার ফলে বিগত দুই দশকে ভারতবর্ষ হয়ে দাড়িয়েছে সারোগেসীর“mother destination” (রুদ্রাপ্পা ২০১৫)। লাফিয়ে বাড়তে থাকা ব্যবসা পরিণত হয়েছে বিলিয়ন ডলার শিল্পে (বিন্ডেল ২০১৬)। সারোগেসী সংশ্লিষ্ট অংশীদারগণ, যথা সারোগেট মাতা, ভূমিষ্ঠ সন্তানের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে ICMR (Indian Council of Medical Research) এর নির্দেশিকা রয়েছে যদিও তা আইনানুগ বলবৎযোগ্য নয়। ফলশ্রুতিতে, আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপিত মামলা, প্রতিবেদনে উঠে আসছে অজস্র কাহিনী। জানা যাচ্ছে সারোগেট কর্মীরা কখনো হচ্ছেন বঞ্চনার শিকার, কখনো পতিত হচ্ছেন মৃত্যুমুখে । পরিত্যক্ত নবজাতককে ঘিরে ফেনিয়ে উঠছে আইনী সমস্যা, বিশেষতঃ যেসব দেশে পরিবর্ত্ত মাতৃত্ব (surrogacy) নিষিদ্ধ। ক্রমবর্ধমান আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে এই শিল্পোদ্যোগটি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কিছু সতর্কতামূলক বিধানিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ART প্রযুক্তির প্রয়োগ ও সংশ্লিষ্ট নিদানশালাগুলোর কার্যবিধি নিয়ন্ত্রণকল্পে ২০০৮ সালে প্রণীত Assisted Reproductive Technology (Regulation) বিলটি উল্লেখযোগ্য। বিলটি পর্যালোচণার পর অন্ততঃ বারতিনেক তার খসরাটি পাল্টানো হলেও তা এযাবৎ আইনে পরিণত করা যায়নি। ২০১৩ সালে বিদেশী queer দম্পতি বা একক অভিভাবক (পিতামাতা) এর জন্য পরিবর্ত্ত পরিসেবা নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৫ সালে সমস্ত বিদেশী নাগরিকদের জন্যই এই সুযোগ বন্ধ করে শুধুমাত্র অন্তর্দেশীয় আবেদনকারীদেরই গ্রাহ্য করা হয়। এপ্রসঙ্গে সর্বসাম্প্রতিক আইনে যাবতীয় ব্যবসায়িক সারোগেসীকেই অপরাধ প্রবিধাণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের Surrogacy (regulation) বিলটি (যার খসরা ২০১৯ এবং ২০২০ সালে পূণর্লিখিত) ২০১৯ সালে সংসদের নিম্নকক্ষে ( লোকসভা) অনুমোদন পেয়েছে। বর্ত্তমানে এটি রাজ্যসভার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিলটিতে ব্যবসায়িক সারোগেসীর ওপর সম্পূর্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে অব্যবহিত সময়ে সারোগেসী কেবলমাত্র পরোপকারের উদ্দেশ্যে এবং বিষমকামী বিবাহিত দম্পতির ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে।
উল্লিখিত বিলটি ‘পরিবার’ ধারনাকে সংজ্ঞায়িত করেছে চলতি heteropatriarchy’র সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে, যার ফলে ক্ষুন্ন হয়েছে সারোগেট কর্মীদের স্বার্থ। সারোগেসী শিল্পের সাথে পেশাগত কারনে যুক্ত মানুষদের শোষনমুক্ত করার আপাতঃ মহৎ রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ আসলে তাদের শ্রমের অধিকার থেকেই বঞ্চিত করেছে। নিয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অকেজো করে দেওয়ায় শ্রমের বাজারে এইসব শ্রমিক/কর্মীদের প্রবেশাধিকার থাকছে না। বর্ত্তমান আইণ মোতাবেক প্রজনন শ্রমকে স্বাভাবিক এবং পরোপকারের নিমিত্ত অভিহিত করায় নারীর শরীরের ওপর কায়েমী পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী হল। কেবল রক্ষণশীল, ভিন্নধর্মী দম্পতি সম্বলিত পরিবারকল্পনার অনুমোদনের মাধ্যমে অস্বীকার করা হয়েছে queer দম্পতি, অবিবাহিত একক মানুষের সন্তানলাভের আকাংখা। এটি চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক চিন্তন, যেখানে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে সমকামিতা বা ‘লিভ ইন’ সম্পূর্ণভাবে আইণস্বীকৃত। বিলটিতে তৎসত্বেও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে লিঙ্গ, যৌনতা ও নাগরিকত্ব সাপেক্ষে স্তরিত প্রজনণের প্রাতিষ্ঠানিকতায় রাষ্ট্রের অধিকারকে।
ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষায় ভারতে সারোগেসী শিল্পের উত্থান ও তাকে অপরাধমূলক বলে অভিহিত করার বর্ত্তমান রাষ্ট্রীয় প্রবণতা বিশেষভাবে কৌতুহলোদ্দীপক। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ‘পরিবার পরিকল্পণা’র মোড়কে প্রায় বলপূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণের (মূলত: গ্রামাঞ্চলে) উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। আশ্চর্যজনকভাবে রাষ্ট্র এখন সেই গ্রামীণ মহিলাদের উর্বরতাকল্পে বিনিয়োগ করছে। যে উর্বরতা একসময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিপন্থী মনে করা হত, তা এখন ব্যবহারযোগ্য অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। ধনী দম্পতিদের ‘পরিবর্ত্ত মাতা’ (surrogate mother) হিসেবে যেসব মহিলারা চুক্তিবদ্ধ হন ও চুক্তিকালীণ শ্রেষ্ঠ সম্ভাব্য সেবাযত্ন পান, দৈনন্দিণ জীবনে তারা ন্যূনতম স্বাস্থ্যপরিসেবাও পান না। সারোগেসী প্রণালীটির মধ্যেই রয়েছে আভ্যন্তরীণ দূর্বলতা ও ক্ষমতার বৈষম্য যা শ্রেণী, জাতপাত ধর্মভিত্তিক স্তরিত প্রজনণ ব্যবস্থায় দুটি বিপরীত মেরুতে ঠেলে দেয় সারোগেট কর্মী ও সম্পাদনকারী দম্পতিগণকে। এটাই স্তরিত বায়োমেডিক্যালাইজেশনের (ক্লার্ক প্রমুখ ২০০৩) শ্রেষ্ঠ বাস্তবানুগ চিত্র্র- যা সুবিধাভোগী ধনীদের কাছে এনে দেয় প্রজনণের উন্নত জৈবপ্রযুক্তি তথা ‘IVF Holidays’; অন্যদিকে দরিদ্র গ্রামীণ মহিলারা পান সাধারণভাবে অপ্রাপ্ত, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিসেবা।
স্তরিত biomedicalization বিষয়টি আরো ইন্ধন পেয়েছে ব্যবসায়িক সারোগেসীকে রাষ্ট্রের তরফে অধিকতর উৎসাহে অপরাধমূলক অভিহিত করায়। সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের সামনে উপার্জনের বিকল্প রাস্তা নেই। ন্যুনতম স্বাস্থ্যপরিসেবার সুযোগ তারা পান না। পারেন না নিজের সন্তানকে নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে লালনপালন করতে। কেবল ‘পরোপকার নিমিত্ত সারোগেসী’কে বৈধতা প্রদান করে, এবং তাকে ভালোবাসার শ্রম (labor of love) আখ্যায়িত করে রাষ্ট্র আদতে মহিলাদের প্রজনণশ্রমকে স্বতঃসিদ্ধ একটি প্রাকৃতিক বিষয়ে পর্যবেসিত করেছে, যদিও সেখানে চুক্তির বিষয়টি রয়েই যাচ্ছে। রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ যে, প্রজনণ একটি আদ্যন্ত শারীরিক ও লিঙ্গনির্দিষ্ট শ্রম; নিছকই তা দানের সামগ্রী হতে পারেনা। ব্যবসায়িক সারোগেসীকে প্রবিধানের মোড়কে অপরাধমূলক নির্ধারিত করায় প্রজনণ শ্রমকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং একইসাথে সারোগেট কর্মীদের আরো বঞ্চনার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
বিল চালু করলেই যে বিলিয়ন ডলার শিল্প হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না, তা সহজেই অনুমেয়। সে খুঁজে নেবে আইনের বাইরে বেআইনী রাস্তা, যে রাস্তায় সারোগেট কর্মী আরো নির্মম অপব্যবহারের শিকার হবে। সারোগেট কর্মীকে অপরাধী তকমা দেবার কারনে সে বিচারের দরবার থেকেই হয়ে যাবে নির্বাসিত।। প্রজনণসংক্রান্ত সুবিচারের লক্ষ্যে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে commercial surrogacy কে অপরাধমুক্ত করা; শিল্পের আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্কৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা এবং আইন প্র্রণয়নের ক্ষেত্রে heteropatriarchal ধাঁচাটির বাইরে ভাবনার পরিসর উন্মুক্ত করা। এইসমস্ত গঠনতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমেই সারোগেট কর্মীরা পাবেন তাদের প্রাপ্য, শ্রমের পূর্ণ মর্যাদা, উপযুক্ত পারিশ্রমিক; সমানাধিকারের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যপরিসেবা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং বংশপরম্পরায় সামাজিক উত্তরণ।
পত্রপঞ্জী :
Bindel, Julie. 2016. “Outsourcing Pregnancy: A Visit to India’s Surrogacy Clinics.” The Guardian. http://www.theguardian.com/global-development/2016/apr/01/outsourcing pregnancy-india-surrogacy-clinics-julie-bindel
Clarke, Adele et al. 2003. “Biomedicalization: Technoscientific Transformations of Health, Illness, and U.S. Biomedicine.” American Sociological Review. 68(2):161-194.
Rudrappa, Sharmila. 2015. Discounted Life: The Price of Global Surrogacy in India. New York University Press.